পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়োগ দুর্নীতি নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা বিভাগে চাকরি বিক্রির অভিযোগ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গভীর সংকটে ফেলেছে। এই দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে এবং কলকাতা হাইকোর্ট একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষত, আগামী পয়লা জুলাইয়ের মধ্যে সিবিআইকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার এবং এসএসসিকে মেধাতালিকা আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু ।


চাকরি বিক্রির অভিযোগ: কীভাবে সামনে এল?

এসএসসির মাধ্যমে উচ্চপ্রাথমিকে কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগ ওঠে। সিবিআই তাদের চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, এই দুটি বিষয়ে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে চাকরি দেওয়া হয়েছে। যদিও এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিবিআই কী ধরনের নথি বা তথ্য পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কলকাতা হাইকোর্ট। আদালত চায়, সিবিআই তাদের তদন্তের ভিত্তি ও প্রাপ্ত নথি স্পষ্টভাবে আদালতে উপস্থাপন করুক।

আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর বেঞ্চে মামলার শুনানিতে উঠে আসে, উচ্চপ্রাথমিকে কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা বিভাগে সিবিআইয়ের সরাসরি কোনও তদন্ত নেই। তবে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির মামলার চার্জশিটে এই দুই বিষয়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগ উল্লেখ ছিল। বিচারপতি পর্যবেক্ষণ করেন, “সিবিআই নিশ্চয় তদন্ত করতে গিয়ে এমন কিছু নথি বা তথ্য পেয়েছে, তার ভিত্তিতেই এমন চার্জশিট দিয়েছে। সেই তদন্তের প্রক্রিয়া এবং নথি, তথ্য আদালত জানতে চায়।”

এই প্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশ দেয়—

সিবিআইকে আগামী ১ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের অবস্থান জানাতে হবে, অর্থাৎ কোন নথির ভিত্তিতে তারা চাকরি বিক্রির অভিযোগ এনেছে তা আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।এসএসসিকে একই সময়ের মধ্যে উচ্চপ্রাথমিকে কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা বিভাগের মেধাতালিকা আদালতে জমা দিতে হবে। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ১ জুলাই ।

নিয়োগ দুর্নীতির বিস্তার ও প্রভাব

২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, রাজ্য সরকার অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে অনিয়মিতভাবে নিয়োগ করেছে, যার ফলে প্রকৃত মেধাবী প্রার্থীরা বঞ্চিত হন। এই দুর্নীতির জেরে প্রায় ২৫,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর নিয়োগ বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্ট, যা পরে সুপ্রিম কোর্টও বহাল রাখে।নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একাধিক স্তরে জালিয়াতি ও তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠে। ওএমআর শিট স্ক্যান ও মূল্যায়নের জন্য যে সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, গোটা প্রক্রিয়াই ছিল “unashamedly orchestrated” অর্থাৎ পরিকল্পিত জালিয়াতি।


সিবিআই তদন্ত ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআইকে যুক্ত করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। যদিও রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে তদন্তে স্থগিতাদেশ চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত আদালত নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে এবং স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক নতুন নিয়োগের নির্দেশ দেয়।এই কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিরোধী দলগুলি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, “নিয়োগ প্রক্রিয়া এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ও জালিয়াতিপূর্ণ ছিল যে, প্রকৃত ও জাল প্রার্থীদের আলাদা করা সম্ভব নয়।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ ও চ্যালেঞ্জ

নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া: আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, তিন মাসের মধ্যে নতুন, স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। তদন্তের স্বচ্ছতা: সিবিআইকে তাদের তদন্তের ভিত্তি আদালতে স্পষ্ট করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্নীতি রোধ করা যায়। প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ: একদিকে ২৫,০০০-এর বেশি চাকরি বাতিল হওয়ায় হাজার হাজার পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়েছেন, অন্যদিকে রাজ্য সরকারের ওপর স্বচ্ছ নিয়োগের চাপ বেড়েছে ।

উপসংহার

এসএসসি-র কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষা বিভাগে চাকরি বিক্রির অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার এক গভীর সংকটকে সামনে এনেছে। আদালতের কঠোর নির্দেশ ও সিবিআই তদন্তের ফলে স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে, এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়, সেটাই এখন রাজ্যবাসীর প্রধান প্রত্যাশা। আগামী ১ জুলাইয়ের শুনানিতে সিবিআই ও এসএসসি কী তথ্য ও নথি আদালতে পেশ করে, তার দিকেই তাকিয়ে গোটা রাজ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here