This Post Contents
Primary 32000 court case:- ৩২ হাজার চাকরি বাতিল মামলায় অভিজিৎ গাঙ্গুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন:- কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় ও বিচার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের মামলাকে কেন্দ্র করে। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত সরাসরি এই রায়ের পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছেন, যা নিয়ে আইনি মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের মামলা বর্তমানে রাজ্যের আইনি ও রাজনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে রাজ্য সরকার তীব্র প্রশ্ন তুলেছে। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্ত তাঁর বক্তব্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিচার পদ্ধতির স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এই নিবন্ধে আমরা এই মামলার বিভিন্ন দিক, রাজ্যের অভিযোগ, এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
Primary 32000 court case

মামলার পটভূমি ও বর্তমান অবস্থা:-
বৃহস্পতিবার বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত দাবি করেন যে, তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সঠিক বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। তিনি বলেন, “সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি শুনানি পর্বে সব পক্ষের বক্তব্য শোনার সুযোগ দেননি। তিনি খেয়ালখুশি মতো শুনানি পরিচালনা করেছেন।”
বিচার পদ্ধতি নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ
১. শুনানি প্রক্রিয়ার ত্রুটি
অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন:
- “সিঙ্গল বেঞ্চ সবাইকে বলার সুযোগ দেননি”
- “বিচারপতি খেয়ালখুশিমতো শুনানি পর্ব চালিয়ে গিয়েছেন”
- “যে কাউকে যখন খুশি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন”
এই অভিযোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের মূল নীতিই হলো সব পক্ষকে সমান সুযোগ দেওয়া।
২. রায় প্রদানে তাড়াহুড়ো
এজি আরও উল্লেখ করেছেন:
- “শুনানি শেষের পরের দিনই রায় ঘোষণা করে দিলেন”
- “এত তাড়া কীসের ছিল?”
- “প্রাথমিক মামলার রায় এর তড়িঘড়ি দেওয়া হল কেন?”
যদিও প্রাক্তন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণ টেনে এজি বলেছেন যে তিনি শুনানি শেষের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রায় দিতেন, কিন্তু তা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত পরম্পরা। এই মামলার জটিলতা ও প্রভাব বিবেচনায় এত দ্রুত রায় দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
৩. পাল্টা হলফনামা তলবের দ্বন্দ্ব
এজি তাঁর বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন:
- “মামলাকারীদের বক্তব্য শোনার পরে শুনানি স্থগিত করে দেন তৎকালীন বিচারপতি”
- “তার পর পর্ষদের কাছে পালটা হলফনামা তলব করেন”
- “অথচ আগে সেই একই আবেদন তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন”
এই বিষয়টি নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চও প্রশ্ন তুলেছে: ‘এখন কেন এই দাবি করছেন? আপনারা তখন তা মেনে নিয়েছিলেন।’
দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে:
- “প্রাথমিকের নিয়োগে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে”
- “দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য প্রমাণ সামনে আসেনি”
- “শুধু অনুমানের ভিত্তিতে বিচারপতি দুর্নীতির কথা লিখে দিলেন”
এজি কিশোর দত্তের যুক্তি, “দুর্নীতির অভিযোগের পরিণাম মারাত্মক।” অর্থাৎ, এত বড় সিদ্ধান্তের জন্য কংক্রিট প্রমাণ থাকা প্রয়োজন ছিল।
অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট নিয়ে দ্বন্দ্ব
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তরফে দাবি করা হয়েছে যে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে আনা হয়েছে। এজি কিশোর দত্ত জানিয়েছেন, দুর্নীতির কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বা প্রমাণ সামনে আসেনি। তিনি বলেন, “দুর্নীতির অভিযোগের পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক। কিন্তু শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে বিচারপতি দুর্নীতির কথা লিখে দিয়েছেন।” তাঁর মতে, আইনকে পাশ কাটিয়ে পুরো রায় দেওয়া হয়েছে, যা বিচার প্রক্রিয়ার নীতি লঙ্ঘন করেছে।
এছাড়া, সিঙ্গল বেঞ্চ অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট না নেওয়ার কারণ দেখিয়ে ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল। তবে পর্ষদ জানিয়েছে, জেলাভিত্তিক মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী টেস্ট নেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলেছেন, “এখন বলছেন মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগে আপনারাই জানিয়েছেন যে মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আপনাদের কোন অবস্থান সঠিক?”সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের একটি বড় ভিত্তি ছিল অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট না নেওয়া। কিন্তু পর্ষদের দাবি:
- “এই অভিযোগের কোনো গুরুত্ব নেই”
- “জেলাভিত্তিক মেধাতালিকা প্রকাশ হয়”
- “ওই টেস্টও সেই অনুযায়ী নেওয়া হয়েছিল”
উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন
ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলার শুনানিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে:
- উত্তরপত্র বা ওএমআর শিট মূল্যায়নে বাইরের সংস্থাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল?
- কীভাবে মূল্যায়নের বরাত পেল ওই সংস্থা?
- কেন প্রথমে বরাতের বিষয়ে অন্য কেউ জানল না?
- কোন আইনের ভিত্তিতে তাদের বরাত দেওয়া হল?
এই প্রশ্নগুলো নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরি করে।
আইনি বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য ফলাফল
এই মামলার আইনি দিকগুলো অত্যন্ত জটিল। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে যে পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো উঠে এসেছে, তা ভারতের সংবিধানের ১৪ ধারা (সমতার অধিকার) এবং ২১ ধারা (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার) এর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।যদি ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে পদ্ধতিগত ত্রুটি পায়, তাহলে তা রদ করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রেও নতুন করে শুনানির প্রয়োজন হতে পারে।
শিক্ষক সমাজ ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
এই মামলা সরাসরি ৩২ হাজার শিক্ষকের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িত। অনেক শিক্ষক যারা বছর ধরে চাকরি করছেন, তারা এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।অন্যদিকে, যারা প্রকৃতপক্ষে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন বলে দাবি করেন, তাদের পক্ষেও এটি একটি বড় ধরনের অবিচার।
রাজনৈতিক প্রভাব
এই মামলার রাজনৈতিক প্রভাবও ব্যাপক। রাজ্য সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ই এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ অবস্থান নিয়েছে।বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা বনাম বিচারিক আচরণবিধি – এই বিতর্ক এখন রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার
৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের মামলায় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিচার পদ্ধতি নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে।এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট মামলার বিষয় নয়, বরং বিস্তৃতভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া, ন্যায়বিচারের নীতি এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে।আগামী ২৩ জুনের শুনানিতে এই মামলার কী দিক উঠে আসে, তা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই এই মামলার একমাত্র কাঙ্ক্ষিত ফল হওয়া উচিত।